ভিটামিন আসলে কী? ভিটামিনের ইতিহাস

ভিটামিন আসলে কী? ভিটামিনের ইতিহাস

 লাইফস্টাইল ডেস্ক: ভিটামিন আসলে এক শ্রেণীর জৈব পদার্থ, যার স্বল্প পরিমান উপস্থিতি মানবদেহের এবং অন্যান্য উচ্চ শ্রেণীর প্রাণীর পুষ্টি ও বিপাক (metabolism) ক্রিয়া, বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় অত্যাবশ্যক ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু মানবদেহের সঠিক বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য যে পরিমান ভিটামিনের প্রয়োজন হয়, তা সাধারণত আমাদের দেহে যথেষ্ট পরিমাণে সংশ্লেষিত হয় না। বিভিন্ন খাদ্য বস্তুর মাধ্যমে অথবা কৃত্তিম উপায়ে ভিটামিনের অভাব পূরণ করতে হয়।

ভিটামিনের ইতিহাস:

কিন্তু এই ভিটামিন জিনিসটা কি, তা সহজে বুঝতে গেলে ভিটামিনের আবিষ্কার সম্পর্কে একটু জানতে হবে।

১৮৯০ সালে নেদারল্যান্ডসের এক বিজ্ঞানী, Christiaan Eijkman, একদিন লক্ষ্য করেন তাঁর গবেষণাগারের সমস্ত মুরগী গুলো polynuritis নামক স্নায়ুতন্ত্রের এক জটিল রোগে আক্রান্ত। এবং সঠিক পুষ্টির অভাবে যে beriberi রোগ হয় তার সাথে স্নায়বিক এই রোগটির যে একটি যোগসূত্র আছে তাও তিনি বুঝতে পারলেন। এই ঘটনার প্রায় ৭ বছর পর, অর্থাৎ ১৮৯৭ সালে তিনি একটি পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান, যে সমস্ত মুরগী গুলোকে পরিশোধিত সাদা চাল (polished white rice) খেতে দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যেই শুধুমাত্র এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। যে সমস্ত মুরগী গুলো অপরিশোধিত ঢেঁকিছাটা চাল (unpolished rice) খায়, তারা কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত হয়নি। অর্থাৎ পরিশোধনের পর চালের গুণগত মানের বা উপাদানগত কোনো পরিবর্তন হয়, যার অনুপস্থিতিতে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী কালে, ১৯০৬-১৯০৭ সালে ব্রিটিশ বায়োকেমিস্ট Sir Frederick Gowland Hopkins বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কিছু অপরিহার্য amino acid প্রাণী দেহে সংশ্লেষিত হতে পারে না। এবং এই অনুপস্থিত পদার্থ (missing nutrients) গুলো সুস্থ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য।

১৯১২ সালে বিজ্ঞানী Hopkins এই missing nutrients গুলোকে ‘অত্যাবশ্যক সহায়ক খাদ্য’ (essential accessory factors or substances) নামে অভিহিত করেন। এই বছরই বিজ্ঞানী Casimir Funk এই এলিমেন্টস বা ফ্যাক্টর গুলোকে vital amines নামকরণ করেন। Funk লক্ষ্য করেন যে ধান থেকে চাল উৎপন্ন করার সময় ধানের বাইরের খোশাটা ফেলে দেওয়া হয়। এবং সেই চাল গুলোই Eijkman এর গবেষণাগারের মুরগী গুলোকে খেতে দেওয়া হত। যদি এই খোশা গুলো না ফেলা হয়, তাহলে কিন্তু মুরগী গুলোর polyneuritis রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকতো না। অর্থাৎ ধানের এই বাইরের খোলসে নিশ্চই এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল (এখন thiamin নামে পরিচিত) যা polyneuritis বা beriberi র মতো রোগের কারণ। Funk পরীক্ষা করে দেখেন এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান টি আসলে একপ্রকার নাইট্রোজেন এমাইন (nitrogen amine) যা প্রাণীদেহের পুষ্টি ও বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যার অভাবে scurvy বা pellagra এর মতো রোগও হতে পারে। অথচ প্রাণীদেহে তা সংশ্লেষিত হয় না। এই কারণে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ অথচ অনুপস্থিত উপাদানটির নামকরণ করেন vital amines বা viatmines। পরবর্তী কালে দেখা যায় সমস্ত vitamines এ নাইট্রোজেন বা এমাইন গ্রুপ থাকে না। তাই নাম পরিবর্তিত হয়ে vitamin করা হয়।

ভিটামিনের বৈশিষ্ট্য:

১) ভিটামিন প্রাণীদেহের বিপাক ক্রিয়ার বা মেটাবলিসমের সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অর্গানিক ক্যাটালিস্ট হিসাবে কাজ করে। খুব স্বল্প পরিমানে উপস্থিত থেকেও প্রোটিন, ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেটের (macro nutrients) সাহায্যে ভিটামিন, মেটাবলিজমের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে।

২) ১৩ টি ভিটামিনের অস্তিত্ব এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে যা আমাদের দেহে খুব অল্প পরিমাণে সংশ্লেষিত হয় অথবা আদৌ সংশ্লেষিত হয় না। এদের মধ্যে কিছু ভিটামিন ফ্যাট এ দ্রাব্য (ভিটামিন A, D, E, K) এবং কিছু ভিটামিন জলে দ্রাব্য (ভিটামিন B, C)। এই fat soluble ভিটামিন গুলোকে সহজে আমরা নিজেদের দেহে সঞ্চয় করতে পারলেও water soluble ভিটামিন গুলো রেচন প্রক্রিয়ার (excretion) মাধ্যমে দেহের বাইরে চলে যায়।

ভিটামিন আসলে কী? ভিটামিনের ইতিহাস

৩) বেশিরভাগ ভিটামিন কো-এনজাইম হিসাবে উৎসেচকের সাথে সঙ্গবদ্ধ হয়ে ক্রিয়া করে। ব্যতিক্রম ভিটামিন C।

৪) কিছু ভিটামিন, যেমন ভিটামিন A, D, K আমাদের মানবদেহে সংশ্লেষিত হলেও, দৈনন্দিন খাদ্যবস্তু থেকে আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিনের যোগান পাই। এছাড়া hypovitaminosis অবস্থায় যখন ভিটামিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকেও কমে যায়, তখন ওষুধের সাহায্যে ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে।

৫) ভিটামিনের অভাবে আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ হতে পারে যা সাধারণত সঠিক খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। কিন্তু শরীরের non regenerative tissue যদি (যেমন চোখের কর্নিয়া) ভিটামিনের অভাবজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে কিন্তু তা অপূরণীয়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাসের কারণে যেমন ভিটামিনের ঘাটতি (primary deficiency) হতে পারে আবার তেমনই অন্য কোনো রোগের উপসর্গ হিসাবেও কিন্তু দেহে ভিটামিন কমে যেতে পারে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *